ঢাকা ০৩:৩৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংসদ ভেঙে দিয়ে সেনা মোতায়েন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০১:২০:৩৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ অক্টোবর ২০১৭
  • ১৯৪ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ৩১ জুলাই সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে শুরু হয় নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাথে ভোট সংশ্লিষ্টদের সংলাপ। গতকাল মঙ্গলবার সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের সাথে সংলাপের মাধ্যমে তা শেষ হয়েছে।

তিন মাসব্যাপী সংলাপে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে।
এর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি। সুশীল সমাজসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল চেয়েছে সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন। সংলাপে অংশ নেয়া বিএনপিসহ ১৮টি রাজনৈতিক দল এর পক্ষে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। বিপক্ষে ছিল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ ৯টি রাজনৈতিক দল। এ ছাড়াও ভোটে সেনা মোতায়েনের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেয় রাজনৈতিক দলগুলো। অংশ নেয়া ২৪টি রাজনৈতিক দল ভোটে সেনা মোতায়েনের পক্ষে নির্বাচন কমিশনকে নিজেদের অবস্থান জানায়। বিপক্ষে বলে আওয়ামী লীগসহ ছয়টি রাজনৈতিক দল। অন্য দিকে সুশীলসমাজ সেনা মোতায়েনের ওপর জোর দিয়ে বলেছেÑ রাস্তাঘাট তৈরি-মেরামত, স্থাপনা তৈরিতে যদি সেনাবাহিনী কাজ করতে পারে তাহলে ভোটে সেনা মোতায়েন কেন করা যাবে না।

এ দিকে ইভিএম প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ দলগুলো পরস্পর বিপরীতমুখী প্রস্তাব দিয়েছে। ভোটে ইভিএম ব্যবহারে আপত্তি জানিয়েছে ১২টি রাজনৈতিক দল। তবে ব্যবহারের পক্ষে বলেছে আটটি দল।

সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের সাথে সংলাপের শেষ দিনে গতকাল সূচনা বক্তব্যে বেশ স্বস্তি নিয়েই প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) এম নুরুল হুদা বলেন, প্রায় তিন মাস ধরে অনেক মূল্যবান কথা শুনেছি, অনেক ভারী ভারী কথা শুনেছি। আজ আপনাদের পেয়ে অনেকটা হালকা অনুভব করছি। এ সময় সিইসি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনারতরী কাব্যগ্রন্থের মানসসুন্দরী কবিতার কয়েকটি পংক্তি তুলে ধরেন। সাবেক সিইসি, নির্বাচন কমিশনারদের পেয়ে তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর কথা জানান নুরুল হুদা। তিনি বলেন, আজ বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে চাই। গল্প পরামর্শ আকারে গ্রহণ করব। যতœ সহকারে তা সংরক্ষণ করব, তা প্রয়োগ করব।
সংলাপে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে তাগিদ দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনাররা। তারা বলেছেন, সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই সব দলকে নির্বাচনে আনতে হবে। এ জন্য যদি ইসিকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে হয় তবে তা-ই করতে হবে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দল না আসায় অনেক ক্ষতি হয়েছে। এর পুনরাবৃত্তি ঘটলে খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ইসিকে পরামর্শ দেন সাবেকরা।

এর আগে ইসি সুশীলসমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সাথেও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে মতবিনিময় করেছেন। সংলাপে সবার আস্থা অর্জনে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করে নির্বাচন কমিশনের ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধারের পরামর্শ দেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিতর্কিত ইভিএম থেকে সরে আসা এবং নির্বাচনের আগে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন। ভোটে কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার ঠেকাতে ইসির ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করে একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ভয়মুক্ত ও সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তারা।

ইসির এই সংলাপ আয়োজন ইতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হলেও এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছেÑ তিন মাস ধরে চলা এই সংলাপের মধ্য দিয়ে উঠে আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব বা দাবি কি আদৌ বাস্তবায়ন হবে। প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী প্রস্তাব দেয়ায় এই সংশয় আরো জোরালো হয়েছে। রাজনীতি বিশ্লেষকেরা বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করাই এখন ইসির মূল চ্যালেঞ্জ। যদি এসব প্রস্তাব এড়িয়ে যাওয়া হয়, তাহলে সংলাপ প্রহসনে পরিণত হতে পারে।

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, নির্বাচন কমিশনকে কার্যকরী করতে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করতে হবে। এ জন্য ইসি নিজেকেই অনেক শক্তিশালী করতে হবে। ভবিষ্যতে নির্বাচন করতে হলে নিজস্ব কর্মকর্তাদের থেকে বাছাই করে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট আইনগুলোকে অভিজ্ঞতার আলোকে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত এবং তাদের এখতিয়ারের বাইরের এভাবে বাছাই করে করণীয় ঠিক করতে হবে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ বলেন, আমাদের সময়ে (রকিব কমিশন) যে ভোট হয়েছে তা আমরা আর চাই না। কারণ আমাদের সময় আইনশৃঙ্খলার অবস্থা অনেক খারাপ ছিল। দেশের অনেক বড় দল নির্বাচনে অংশ নেইনি। আমি মনে করি সবার অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন হবে। কমিশনের মূল লক্ষ্য থাকবে নির্বাচন সুষ্ঠু করা। যেহেতু সংলাপে সব দল অংশ নিয়েছে আমি মনে করি, তারা নির্বাচনেও অংশ নেবে। এ জন্য নির্বাচনটাকে সুষ্ঠু করার বিষয়ে কমিশনকে উদ্যোগ নিতে হবে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ সম্পন্ন করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সুবিধামতো সুপারিশ করেছে। নির্বাচন কমিশন আইন সংশোধন করবে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইলেও সরকারপক্ষ বলেছে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ইসি এখন কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারে এটি এখন দেখার বিষয়। ইসিকে এখন থেকে ভাবতে হবে তাদের সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। সবার জন্য সমান সুযোগ ও পরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হলে তা কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সুবিধামতো প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের মানদণ্ড হলো নির্বাচনে জয়ী হওয়া। আর নির্বাচন কমিশনের মানদণ্ড হলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা। সে আলোকেই ইসিকে প্রস্তাবগুলো নিয়ে বিবেচনা করতে হবে। অনেক প্রস্তাব বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। তবে যেগুলো ইসি বাস্তবায়ন করতে পারবে, সেগুলো তাদের করা উচিত। আর যেগুলো সরকারের বিষয়, সেগুলো নিয়ে সরকারকে অনুরোধ করতে হবে। সরকার না শুনলে সে অবস্থায় ইসি যদি মনে করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তাহলে তা তাদের স্পষ্ট করে বলতে হবে।

এর আগে গত ১৬ ও ১৭ আগস্ট গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে সংলাপ করে ইসি। প্রথম দিনের সংলাপে ইসির ক্ষমতা প্রয়োগের পরামর্শ দেন সিনিয়র সাংবাদিকেরা। সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রয়োজনে সেনা মোতায়েন করার পরামর্শ দেন অনেকে। দ্বিতীয় দিনের সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ধারাবাহিক সংলাপ করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দেন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন যাই হোক না কেন সব চাপের ঊর্ধ্বে থেকে ইসিকে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান তারা।

গত জুলাইয়ে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত কর্মপরিকল্পনায় সাতটি করণীয় বিষয় শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো আইনি কাঠামোগুলো পর্যালোচনা ও সংস্কার, কর্মপরিকল্পনার ওপর পরামর্শ গ্রহণ, সংসদীয় এলাকার নির্বাচনী সীমানা পুনঃনির্ধারণ, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুতকরণ এবং বিতরণ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা এবং নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

সংসদ ভেঙে দিয়ে সেনা মোতায়েন

আপডেট টাইম : ০১:২০:৩৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ অক্টোবর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ৩১ জুলাই সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে শুরু হয় নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাথে ভোট সংশ্লিষ্টদের সংলাপ। গতকাল মঙ্গলবার সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের সাথে সংলাপের মাধ্যমে তা শেষ হয়েছে।

তিন মাসব্যাপী সংলাপে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে।
এর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি। সুশীল সমাজসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল চেয়েছে সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন। সংলাপে অংশ নেয়া বিএনপিসহ ১৮টি রাজনৈতিক দল এর পক্ষে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। বিপক্ষে ছিল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ ৯টি রাজনৈতিক দল। এ ছাড়াও ভোটে সেনা মোতায়েনের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেয় রাজনৈতিক দলগুলো। অংশ নেয়া ২৪টি রাজনৈতিক দল ভোটে সেনা মোতায়েনের পক্ষে নির্বাচন কমিশনকে নিজেদের অবস্থান জানায়। বিপক্ষে বলে আওয়ামী লীগসহ ছয়টি রাজনৈতিক দল। অন্য দিকে সুশীলসমাজ সেনা মোতায়েনের ওপর জোর দিয়ে বলেছেÑ রাস্তাঘাট তৈরি-মেরামত, স্থাপনা তৈরিতে যদি সেনাবাহিনী কাজ করতে পারে তাহলে ভোটে সেনা মোতায়েন কেন করা যাবে না।

এ দিকে ইভিএম প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ দলগুলো পরস্পর বিপরীতমুখী প্রস্তাব দিয়েছে। ভোটে ইভিএম ব্যবহারে আপত্তি জানিয়েছে ১২টি রাজনৈতিক দল। তবে ব্যবহারের পক্ষে বলেছে আটটি দল।

সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের সাথে সংলাপের শেষ দিনে গতকাল সূচনা বক্তব্যে বেশ স্বস্তি নিয়েই প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) এম নুরুল হুদা বলেন, প্রায় তিন মাস ধরে অনেক মূল্যবান কথা শুনেছি, অনেক ভারী ভারী কথা শুনেছি। আজ আপনাদের পেয়ে অনেকটা হালকা অনুভব করছি। এ সময় সিইসি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনারতরী কাব্যগ্রন্থের মানসসুন্দরী কবিতার কয়েকটি পংক্তি তুলে ধরেন। সাবেক সিইসি, নির্বাচন কমিশনারদের পেয়ে তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর কথা জানান নুরুল হুদা। তিনি বলেন, আজ বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে চাই। গল্প পরামর্শ আকারে গ্রহণ করব। যতœ সহকারে তা সংরক্ষণ করব, তা প্রয়োগ করব।
সংলাপে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে তাগিদ দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনাররা। তারা বলেছেন, সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই সব দলকে নির্বাচনে আনতে হবে। এ জন্য যদি ইসিকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে হয় তবে তা-ই করতে হবে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দল না আসায় অনেক ক্ষতি হয়েছে। এর পুনরাবৃত্তি ঘটলে খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ইসিকে পরামর্শ দেন সাবেকরা।

এর আগে ইসি সুশীলসমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সাথেও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে মতবিনিময় করেছেন। সংলাপে সবার আস্থা অর্জনে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করে নির্বাচন কমিশনের ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধারের পরামর্শ দেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিতর্কিত ইভিএম থেকে সরে আসা এবং নির্বাচনের আগে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন। ভোটে কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার ঠেকাতে ইসির ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করে একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ভয়মুক্ত ও সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তারা।

ইসির এই সংলাপ আয়োজন ইতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হলেও এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছেÑ তিন মাস ধরে চলা এই সংলাপের মধ্য দিয়ে উঠে আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব বা দাবি কি আদৌ বাস্তবায়ন হবে। প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী প্রস্তাব দেয়ায় এই সংশয় আরো জোরালো হয়েছে। রাজনীতি বিশ্লেষকেরা বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করাই এখন ইসির মূল চ্যালেঞ্জ। যদি এসব প্রস্তাব এড়িয়ে যাওয়া হয়, তাহলে সংলাপ প্রহসনে পরিণত হতে পারে।

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, নির্বাচন কমিশনকে কার্যকরী করতে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করতে হবে। এ জন্য ইসি নিজেকেই অনেক শক্তিশালী করতে হবে। ভবিষ্যতে নির্বাচন করতে হলে নিজস্ব কর্মকর্তাদের থেকে বাছাই করে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট আইনগুলোকে অভিজ্ঞতার আলোকে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত এবং তাদের এখতিয়ারের বাইরের এভাবে বাছাই করে করণীয় ঠিক করতে হবে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ বলেন, আমাদের সময়ে (রকিব কমিশন) যে ভোট হয়েছে তা আমরা আর চাই না। কারণ আমাদের সময় আইনশৃঙ্খলার অবস্থা অনেক খারাপ ছিল। দেশের অনেক বড় দল নির্বাচনে অংশ নেইনি। আমি মনে করি সবার অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন হবে। কমিশনের মূল লক্ষ্য থাকবে নির্বাচন সুষ্ঠু করা। যেহেতু সংলাপে সব দল অংশ নিয়েছে আমি মনে করি, তারা নির্বাচনেও অংশ নেবে। এ জন্য নির্বাচনটাকে সুষ্ঠু করার বিষয়ে কমিশনকে উদ্যোগ নিতে হবে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ সম্পন্ন করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সুবিধামতো সুপারিশ করেছে। নির্বাচন কমিশন আইন সংশোধন করবে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইলেও সরকারপক্ষ বলেছে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ইসি এখন কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারে এটি এখন দেখার বিষয়। ইসিকে এখন থেকে ভাবতে হবে তাদের সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। সবার জন্য সমান সুযোগ ও পরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হলে তা কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সুবিধামতো প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের মানদণ্ড হলো নির্বাচনে জয়ী হওয়া। আর নির্বাচন কমিশনের মানদণ্ড হলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা। সে আলোকেই ইসিকে প্রস্তাবগুলো নিয়ে বিবেচনা করতে হবে। অনেক প্রস্তাব বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। তবে যেগুলো ইসি বাস্তবায়ন করতে পারবে, সেগুলো তাদের করা উচিত। আর যেগুলো সরকারের বিষয়, সেগুলো নিয়ে সরকারকে অনুরোধ করতে হবে। সরকার না শুনলে সে অবস্থায় ইসি যদি মনে করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তাহলে তা তাদের স্পষ্ট করে বলতে হবে।

এর আগে গত ১৬ ও ১৭ আগস্ট গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে সংলাপ করে ইসি। প্রথম দিনের সংলাপে ইসির ক্ষমতা প্রয়োগের পরামর্শ দেন সিনিয়র সাংবাদিকেরা। সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রয়োজনে সেনা মোতায়েন করার পরামর্শ দেন অনেকে। দ্বিতীয় দিনের সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ধারাবাহিক সংলাপ করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দেন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন যাই হোক না কেন সব চাপের ঊর্ধ্বে থেকে ইসিকে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান তারা।

গত জুলাইয়ে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত কর্মপরিকল্পনায় সাতটি করণীয় বিষয় শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো আইনি কাঠামোগুলো পর্যালোচনা ও সংস্কার, কর্মপরিকল্পনার ওপর পরামর্শ গ্রহণ, সংসদীয় এলাকার নির্বাচনী সীমানা পুনঃনির্ধারণ, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুতকরণ এবং বিতরণ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা এবং নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ।